top of page

ভারতীয় রেল ১৮৫৩ – ১৯৪৭ প্রযুক্তি অর্থনীতি ও ঔপনিবেশিকতা (প্রবন্ধ)

লেখক : গৌতমকুমার ভগত

প্রকাশক : ভিরাসত আর্ট পাবলিকেশন


দৈর্ঘ্য : ২৪০ মিমি

প্রস্থ : ১৮৭ মিমি

স্পাইন : ২৮ মিমি

পৃষ্ঠা : ৩১৪


প্রকাশকের কথা


রেলপথের বিস্তার লাভের কাহিনি নিজেই ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তবে বিশ্বময় এই গল্পে কেবল লোহা-লক্করের টানাটানির মধ্যে রেললাইন পাতা, জঙ্গল কাটা, সেতু তৈরি করা আর সেসব করতে গিয়ে কুলি-মজদুরদের বাঘ-সিংহের পেটে যাওয়া, সাপের ছোবলে প্রাণ যাওয়া বা নানা রোগভোগে মরে যাওয়ার গল্পই নয়, গল্প রয়েছে বাণিজ্য, অর্থনৈতিক এমনকি রাজনৈতিক বিবর্তনেরও— মানে ঔপনিবেশিকতারও। আর রয়েছে কুলি লাইনের গল্প, যেখানে বিভিন্ন ভাষা ও ধর্মের অনুসারী মানুষের মিশে যাওয়ার গল্প— এক নতুন সংস্কৃতির জন্মকথা। আর সেইসব নিয়ে গবেষণা করে, দায়সারা গোছের পরিচালক দ্বারা চালিত মহাফেজখানা থেকে দলিল-দস্তাবেজ খুঁজে এবং চেয়ে-পেয়ে বই লেখা খুব সহজ কাজ না। কিন্তু পরিশ্রমী গবেষক গৌতমকুমার ভগত এই অসম্ভব কাজটি সম্ভব করেছেন। বই-এর ব্যবহৃত সব ছবি লেখকের কাছ থেকে পাওয়া। আর তাঁর অধ্যবসায় ও মেধার মূল্য হিসেবেই হয়তো বিশিষ্ট অধ্যাপক ইতিহাসবিদ দীপক কুমার এই বইয়ের একটি মূল্যবান ভূমিকা লিখেছেন। তাঁকে প্রকাশনার পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। কৃতজ্ঞতা জানাই অনান্য বিশিষ্টজনকে, যাঁরা বইটির জন্য প্রশংসা বার্তা পাঠিয়েছেন তাঁদের প্রতি। লেখককে বিশেষ করে অভিনন্দন জানাই এই কারণে যে তিনি উপযুক্ত ফোটোগ্রাফি সমৃদ্ধ এই বইটির প্রত্যক্ষ উপাদানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এর নামকরণ করেছেন। বইটি আশা করি পাঠক খুব দ্রুত আপন করে নেবেন। বইটির নির্মাণ কর্মের সঙ্গে যুক্ত সকলকে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই।

 

গণেশ প্রতাপ সিং

 

  

গ্রন্থ প্রসঙ্গ


ঔপনিবেশিক ভারতে রেল ব্যবস্থার প্রবর্তনের সঙ্গে পাশ্চাত্য প্রযুক্তির স্থানান্তরের বিষয়টি গভীরভাবে সম্পৃক্ত। রেলের হাত ধরেই শিল্পায়িত ব্রিটেনের প্রযুক্তিগত আবিষ্করণ ও প্রযুক্তিগত কৃৎকৌশলের আগমন ঘটেছিল ভারতবর্ষে। ঔপনিবেশিকতাবাদ পাশ্চাত্য দেশগুলির শ্রেষ্ঠত্বের ফসল ছিল তাই নয়, এর পশ্চাতে যে-সমস্ত শক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তা হল বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত আবিষ্করণ। প্রযুক্তিবিদ্যা যেহেতু বহুমাত্রিক, তাই এর প্রয়োগের ফলে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে যোগসূত্র রচিত হয়ে থাকে এবং এর মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে এক বৃহদাকারের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। শিল্পবিপ্লব ও ঔপনিবেশিকরণের প্রক্রিয়া পরস্পর পরস্পরের হাত ধরে অগ্রসর হয়েছিল উন্নয়নের পথে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করেছিল তা নয়, প্রযুক্তিবিদ্যা এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্করণ সেই শক্তিকে অধিকমাত্রায় বলশালী করে তুলেছিল। সাইকেল থেকে আরম্ভ করে টাইপ করার যন্ত্র পর্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা উদ্ভূত বিষয়াদির সঙ্গে যেভাবে নিজেদের যোগসূত্র রচনা করেছিল তাতে ভারতীয়দের জীবনে আধুনিকতার গুরুত্ব ক্রমবর্ধমান হয়ে উঠেছিল।

জ্ঞানের বিচ্ছুরণের তত্ত্ব বা প্রযুক্তির স্থানান্তর সম্পর্কিত আলোচনার মধ্য দিয়ে যে-বিষয়টি পরিস্ফুটিত তা হল ভারতবর্ষে রেলওয়ের মধ্য দিয়েই সুপ্রশস্ত হয়ে উঠেছিল পাশ্চাত্য প্রযুক্তিবিদ্যার আগমনের পথ। জ্ঞানের বিচ্ছুরণ তত্ত্ব পাশ্চাত্য প্রযুক্তির স্থানান্তরকে একপেশে প্রক্রিয়ারূপে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ঔপনিবেশের প্রজাদের ওপর শাসককুল যে-পাশ্চাত্য প্রযুক্তিকে আলোকিত করেছিল তাতে ঔপনিবেশের মানুষ সেটিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেছিল, বা সেই প্রযুক্তিকে মান্যতা দান করেছিল তা বলা যাবে না। কোনো-কোনো ক্ষেত্রে এই ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশের মানুষ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধেও শামিল হয়েছিল। পাশ্চাত্য জগৎ থেকে আমদানিকৃত প্রযুক্তিবিদ্যা ভারতীয় ক্ষেত্রে অপরিবর্তনীয় এবং অবিকৃতভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। ইংরেজ বাস্তুকারেরা তাদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন যে দেশীয় পদ্ধতির সঙ্গে পাশ্চাত্য প্রযুক্তির মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। তাই পাশ্চাত্য প্রযুক্তি অগ্রগামী ও আধুনিক হওয়া সত্ত্বেও দেশীয় প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্তি সাধনের মধ্য দিয়েই লক্ষ্যে পৌঁছানো গিয়েছিল এবং ভারতবর্ষের মতো বিশাল উপমহাদেশে রেলপথ প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পূর্ণ করা গিয়েছিল। এই স্থানান্তরিত প্রযুক্তি অবিকৃত ছিল না বলেই এটিকে পাশ্চাত্য প্রযুক্তির ভারতীয়করণ নামে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য প্রযুক্তিবিদ্যা স্থানান্তরের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র ছিল রেল। অনুরূপভাবে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে কারিগরি শিক্ষার প্রবর্তন ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের পত্তনের ক্ষেত্রে ভারতীয় রেল সহায়তা দান করেছিল প্রত্যক্ষভাবে। ভারতীয় রেলের প্রবর্তনের পশ্চাতে কাজ করেছিল ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ। ভারতে রেলব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী ও তৎপরবর্তী সময়কাল থেকে ক্রমবর্ধমান মানুষের জীবনযাত্রায় রেল ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। প্রারম্ভিক পর্বে যা ছিল ভারতীয়দের কাছে দর্শনীয় বস্তু, সেই রেল পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে লক্ষ-লক্ষ ভারতীয় যে-অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিল তাতে এক অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের মানুষের যোগসূত্র রচিত হয়েছিল, যা শেষপর্যন্ত জন্ম দিয়েছিল ভারতীয়ত্ববোধের। রেল প্রযুক্তির সঙ্গে ভারতীয়দের দৈনন্দিন জীবনের সম্পর্ক কেবলমাত্র রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছিল, একইসঙ্গে এরই মধ্য দিয়েই রচিত হয়েছিল যোগসূত্র।

পাশ্চাত্য জগৎ যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে তথাকথিত আধুনিকতায় উত্তরণ ঘটিয়েছে তখন ভারতীয় সমাজ পরিচালিত হচ্ছিল সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের দ্বারা। এই মূল্যবোধ ভারতীয়দের কুসংস্কার, অজ্ঞতা, জাতব্যবস্থা ও বর্ণবৈষম্যের দুষ-পরিবর্তনীয়তার জন্য পরিবর্তনকে প্রত্যাখ্যান করেছিল সম্পূর্ণরূপে। ভারতীয় সমাজে অস্তিত্বশীল ছিল শতাব্দী প্রাচীন সামাজিক মূল্যবোধ, জাতব্যবস্থা এবং অস্পৃশ্যতা। এই বিষয়গুলি ছিল একান্তভাবে আধুনিকতার পরিপন্থী। এই ধরনের সামাজিক ব্যবস্থার মর্মমূলে আঘাত হেনেছিল ভারতীয় রেল। এমনকি অঞ্চল ও ধর্মের ওপরেও রেল ব্যবস্থার আঘাত নেহাত অকিঞ্চিৎকর ছিল না। এইভাবে ভারতীয় রেল অস্পৃশ্যতা, আঞ্চলিকতা, ধর্মের বিভেদীকরণ, জাতপাত ব্যবস্থা, এককথায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বৈষম্যকে ক্রমবর্ধমান করে সমষ্টিগত জাতিসত্তার আবির্ভাবকে অনিবার্য করে তুলেছিল। তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল ঐক্যবোধ ও মেলবন্ধন, যা ধীরে ধীরে প্রস্তুত করেছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ। তারা যে উন্নতমানের প্রযুক্তিবিদ্যার অধিকারী সেটি ব্রিটিশদের মধ্যে যে-অহংবোধের জন্ম দিয়েছিল তা জাতিগত বৈষম্যকে তীব্রতর করে তোলার পক্ষে ছিল যথেষ্ট সহায়ক।

রেলপথকে প্রায়শই ঔপনিবেশিক ভারতের ক্ষেত্রে চিহ্নিত করা হয়েছে পাশ্চাত্য প্রযুক্তির স্থানান্তরের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্ররূপে, কিন্তু এ-কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না যে পাশ্চাত্য প্রযুক্তির অন্যতম প্রধান ফসল ভারতীয় রেল হলেও এই সুবিশাল উদ্যোগ দেশীয় কৃৎ-কৌশলের উন্নয়নে সহায়তা দান করেছিল প্রত্যক্ষভাবে। ঔপনিবেশিক ভারতে রেল ব্যবস্থায় পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সমাজ-জীবনে কী ধরনের পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল বা এই পরিবর্তনের মাত্রা কতখানি ছিল, সে-সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করা হয়েছে এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থের লেখক গৌতম কুমার ভগত ঔপনিবেশিক আমলের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে একটি গঠনমূলক ইতিহাস রচনার প্রয়াস করেছেন। তৎকালীন ইংরেজ শাসকদের তৎপরতা তাদের ব্যক্তিগত পত্রাদি ও দিনপঞ্জি এবং জাতীয় লেখ্যাগারের আকরাদির মধ্যে যে-যোগসূত্র বর্তমান তার ভিত্তিতে ভারতীয় রেলের সমাজ, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি সম্পর্কে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে এই গ্রন্থে। এই অতি পরিশ্রম ও মেধাভিত্তিক কাজটি করতে গিয়ে তিনি কোনও অতিরঞ্জনের আশ্রয় নেননি। তাই চিন্তাশীল পাঠক প্রত্যক্ষভাবে এক সময়ের বহুধা বিভক্ত ভারতবর্ষে ভাষা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া তথা জাতীয়তাবোধের উন্মেষ রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার অবদানের রসদ এই গবেষণামূলক গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আশা রাখি। এই বইটি পড়লে সমস্ত পাঠক প্রায় একশত বছরের ভারতীয় রেলের বিস্তারের ইতিহাস পাঠের সঙ্গে সঙ্গে এর আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোর বিবর্তনের ধারাটিও সম্যক বুঝতে পারবেন।

 

ড. চিত্তব্রত পালিত : মানব সভ্যতার গতিপথ সবসময় সমানুপাতিক হয় না। কখনো-কখনো এতে যুগান্তর ঘটে যায়। রেল ব্যবস্থার প্রবর্তনও তেমন একটি যুগান্তকারী ঘটনা। আর এইসব যুগান্তকারী প্রবর্তনার ঐতিহাসিক উপাদান নিরূপণ করা সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে ভারতীয় রেল ব্যবস্থা ও তাকে কেন্দ্র করে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিকাঠামোর মৌলিক রূপান্তরের ঐতিহাসিক সূত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে যে-অভিনিবেশ দরকার সেটা এই বইটির ক্ষেত্রে যে পর্যাপ্ত হয়েছে তা এর পাতায় পাতায় একঝলক চোখ রাখলেই বোঝা যায়।

Comments


bottom of page